Bikes

নতুন বাইক কেনার আগে ১৫ টি বিষয় খেয়াল রাখুন

প্রতিটা ছেলের বাইক কেনা একটি বড় স্বপ্ন । মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে যারা বাইক কেনার স্বপ্ন দেখে তারা যানে একটি বাইক কিনতে তাদের কতো কিছু বিসর্জন ও চিন্তা করতে হয়। বাইক কেনা আমার জীবনের অন্যতম আবেগময় ও বড় সিদ্ধান্ত ছিল। আমি যখন প্রথম বাইক কেনার কথা ভাবি, তখন বুঝে উঠতেই পারছিলাম না কোন বাইকটি কিনবো। চারপাশের মানুষের পরামর্শ, ইউটিউব ভিডিও, দোকানদারদের কথা — সব মিলে মাথা গুলিয়ে যাচ্ছিলো।

এই লেখাটা একদম নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লিখছি। যারা নতুন বাইক কিনতে যাচ্ছেন, তাদের যেন আমার মতো দৌড়াদৌড়ি করতে না হয়। নিচে আমি ১৫ টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছি যেগুলো নতুন বাইক কেনার আগে অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত।


১. বাজেট ঠিক করুন

আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বাজেট ঠিক না করে বাইক খুঁজতে গেলে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া খুব সহজ হয়ে যায়। আপনি যদি ২ লাখ টাকা বাজেট করেন, তার মধ্যে বাইকের দাম, রেজিস্ট্রেশন ফি, হেলমেট, ইনস্যুরেন্স — সব কিছুই ধরতে হবে।

ব্যক্তিগত টিপস: সব সময় বাইকের দামের সাথে অতিরিক্ত ১৫-২০ হাজার টাকা রিজার্ভ রাখুন আনুষঙ্গিক খরচের জন্য।


২. কী উদ্দেশ্যে বাইক কিনছেন?

এই প্রশ্নটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি অফিস যাওয়ার জন্য বাইক খুঁজেন, তাহলে ফুয়েল-এফিশিয়েন্ট বাইক ভালো। আবার আপনি যদি স্পোর্টস বাইক চান, তাহলে লুক আর পারফরম্যান্সে জোর দিতে হবে।

আমার ক্ষেত্রে: আমি মূলত শহরে চলাচলের জন্য বাইক খুঁজছিলাম, তাই মাইলেজ, লাইট ও কন্ট্রোল ছিল অগ্রাধিকার।


৩. মটরসাইকেল ব্র্যান্ড নির্বাচন

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বাইক কেনার সময় ব্র্যান্ড নির্বাচন করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলোর একটি। আমি প্রথমে এক চাইনিজ ব্র্যান্ডের বাইকের প্রতি আগ্রহী হয়েছিলাম কারণ দাম কম। কিন্তু পরে জানলাম, সার্ভিস সেন্টার হাতে গোনা কয়েকটা, পার্টস পাওয়া মোটামোটি কঠিন। বাংলাদেশে যেহেতু Yamaha, Honda, TVS, Bajaj, Hero-এর মতো বিশ্বস্ত কোম্পানিগুলো রয়েছে, তাই সেগুলোর তুলনামূলক দিকগুলো জেনে নেওয়া দরকার।

Yamaha – লুক, ফিচার আর রাইডিং কমফোর্টে দুর্দান্ত। কিন্তু দাম ও পার্টস খরচ তুলনামূলক বেশি। যারা স্টাইল ও পারফরম্যান্স খোঁজেন, তাদের জন্য পারফেক্ট হবে।

Honda – স্মুথ ইঞ্জিন ও দীর্ঘস্থায়ী পারফরম্যান্স এর জন্য এই কম্পানির বাইকগুলি বিখ্যাত। মাইলেজ ও সার্ভিস ব্যাকআপ ভালো। একটু সিম্পল ডিজাইন হলেও মানে কোনো কমতি নেই।

TVS – বাজেট ও পারফরম্যান্সের দুর্দান্ত ব্যালেন্স রয়েছে। Raider বা Apache সিরিজে আধুনিক প্রযুক্তি ও স্মার্ট ডিজাইন পাওয়া যায়। রিসেল ভ্যালুও মোটামুটি ভালো।

Bajaj – মাইলেজ ও পার্টসের সহজলভ্যতা দিক থেকে এটি এগিয়ে। তবে অনেক মডেলের ভাইব্রেশন ইস্যু ও ফিনিশিং কিছুটা কম বলে মনে হয়।

Hero – শহরে চলাচলের জন্য লাইটওয়েট ও ফুয়েল-ইকোনমিক বাইক দেয়। তবে স্টাইল ও স্পিডপ্রেমীদের জন্য এই বাইকগুলো নয়।

→ আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলি, যারা বাইককে শুধুই বাহন নয় বরং নিজের সঙ্গী মনে করেন, তাদের উচিত প্রয়োজন অনুযায়ী ব্র্যান্ড নির্বাচন করা। কারও ক্ষেত্রে পারফরম্যান্স গুরুত্বপূর্ণ, কারও জন্য মাইলেজ। তাই অন্যের কথায় নয়, নিজের দরকার অনুযায়ী ব্র্যান্ড বেছে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।


৪. ইঞ্জিন ক্যাপাসিটি (সিসি)

বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৭৫ সিসি পর্যন্ত বাইকের লিমিট রয়েছে। পূর্বে এই সীমা ছিল ১৬৫ সিসি, যা পরে ৩৭৫ সিসি করা হয়েছে। তবে বর্তমানে বাজারে ১০০ সিসি থেকে ১৫০ সিসি — এই রেঞ্জে প্রচুর ভালো বাইক রয়েছে।

আমি কী করলাম: আমি ১50 সিসির বাজাজ পালছার বাইক বেছে নিয়েছিলাম কারণ এটা অফিস + মাঝেমাঝে ট্যুর দুইয়ের জন্যই যথেষ্ট ছিল।


৫. বাইক কেনার সঠিক সময় কখন?

বছরের শেষ দিকে বা ঈদ/পুজা অফার চলাকালে বাইক কোম্পানিগুলো ছাড় দেয়। আমি ডিসেম্বর মাসে বাইক কিনেছিলাম, প্রায় ১০ হাজার টাকা ডিসকাউন্ট পেয়েছিলাম।
→ এটা অনেকেই মিস করে।


৬. মাইলেজ এবং ফুয়েল খরচ

বর্তমান জ্বালানি তেলের দামে মাইলেজ অবশ্যই বড় বিষয়। বাইকের ক্যাটালগে ৪৫ কিমি/লিটার লেখা থাকলেও বাস্তবে তা হয়তো ৩০–৩৫ কিমি/লিটার হয়।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা: আমার বাইক শুরুতে ৩৫ দিচ্ছিল, একটু চালিয়ে ও সার্ভিসিং করার পর ৪০-৪২ পেয়েছি।


৭. বাইক কেনার পর প্রথম ৬ মাস কীভাবে ব্যবহার করবেন (Break-in Period Tips)

  • শুরুতে ৫০ কিমি/ঘণ্টার বেশি চালানো উচিত নয়।
  • প্রতি ১০০০ কিমি পর পর সার্ভিস করালে ভালো।
  • পেট্রল-অকটেন মিক্স করা যাবে না।
  • প্রথম অবস্থায় বাইকটি এক হাতে (একজন ব্যাক্তি) চালানো।
    → আমি প্রথম ৩ মাস নিয়ম মানার ফলে আমার বাইকের পারফরম্যান্স অনেক ভালো পেয়েছিলাম।

৮. মেইনটেন্যান্স খরচ ও সহজলভ্যতা

সব বাইক’ই সুন্দর মনে হয় যখন নতুন হয়। কিন্তু কিছুদিন পর যদি মেইনটেন্যান্স ব্যয় বেশি হয়, তখন বোঝা যায় এটা কতো বড় সমস্য হয়ে দাড়ায়। মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকের হাতেই সবসমই টাকা থাকে না, যার ফলে যখন তখন বাইকের মেইনটেন্যান্স চাইলেই টাকার অভাবে করানো যায় না। আর যদি পার্টস এর দাম কম হয় তাহলে হয়তো তেমন কোন সমস্যায় পরতে হয় না, সহযেই কাজ করানো যায়।

আমার টিপস: যেসব বাইকের স্পেয়ার পার্টস লোকাল মার্কেটে পাওয়া যায়, এবং মেকানিকরা চিনে — সেই ব্র্যান্ডকে অগ্রাধিকার দিন। আপনি এর জন্য এই পোস্টের ৩ নাম্বার পয়েন্টটি ফলো করতে পারেন।


৯. কাগজপত্র ও রেজিস্ট্রেশন ফি

বাইক কিনে ব্যবহার শুরু করার আগে কাগজপত্র ঠিক আছে কি না, সেটা অবশ্যই নিশ্চিত করুন। অনেকেই বাইক কিনে পরে বুঝতে পারেন রেজিস্ট্রেশন খরচ অনেক বেশি। আর যদি পুরাতন বা রিসেলার থেকে বাইক নিতে চান তা হলে ইনস্যুরেন্স ও কাগজপত্র জাল কিনা সেগুলো চেক করে নিবেন। কাগজগুলো চেক করতে বিআরটিএর অফিশিয়াল অ্যাপ অথবা ওয়েব সাইট ভিজিট করতে পারেন।

টিপস: শোরুম থেকে বাইক কেনার সময় জেনে নিন তারা রেজিস্ট্রেশন করে দিচ্ছে কি না এবং খরচ কত।


১০. সিটিং পজিশন ও রাইডিং কমফোর্ট

সবচেয়ে অবহেলিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটা বাইক দেখতে যতই সুন্দর হোক না কেন, যদি চালাতে অস্বস্তি হয় তবে সে বাইক বেশি দিন চালাতে পারবেন না। অথবা আস্তে আস্তে বাইক এর প্রতি মায়া কমে যাবে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা: আমি একবার Apache RTR কিনতে গিয়ে সিট পজিশনে অস্বস্তি পেয়ে TVS Raider বেছে নিয়েছিলাম।


১১. বাইকের শব্দ ও ভাইব্রেশন

অনেক বাইকেই ইঞ্জিন স্টার্ট দিলে একটা রুক্ষ শব্দ হয় বা ভাইব্রেশন লাগে। লম্বা সময় চালালে এটা বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়ায়।

পরামর্শ: বাইক টেস্ট ড্রাইভ নিন। নিজে অনুভব করুন কমফোর্ট কেমন, হ্যান্ডলিং, সিটিং পজিশন ঠিক আছে কি না এই বিষয় গুলো দেখুন।


১২. রিসেল ভ্যালু

এই বিষয়টা অনেকে মাথায় রাখেন না, কিন্তু আমি রাখি। ২-৩ বছর পর আপনি যদি বাইকটা বিক্রি করতে চান, তখন রিসেল ভ্যালু খুবই কাজে দেবে।

উদাহরণ: Yamaha বা Honda-র বাইকের রিসেল ভ্যালু সাধারণত বেশি। চাইনিজ বাইকগুলোর রিসেল ভ্যালু অনেক কমে যায়।


১৩. বাইক চুরি প্রতিরোধে কী করবেন? (প্রসঙ্গত খুবই প্রয়োজনীয়)

বাংলাদেশে বাইক চুরি একটি মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে যেসব জায়গায় নির্দিষ্ট পার্কিং সিস্টেম নেই। আমি নিজেই একবার এ ধরনের ঝামেলায় পড়েছিলাম— একবার বাসার নিচে দাঁড় করানো ছিলো, আমি বাসার উপরে উঠার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চোর বাইক নিয়ে পালাতে যাচ্ছিল, সৌভাগ্যবশত পাশে থাকা একজন সিকিউরিটি দেখে ফেলায় বেঁচে গিয়েছিলাম। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝেছি, শুধু চাবি দিয়ে বাইক লক করলেই নিরাপদ নয়।

যা করা উচিত:

  1. ডুয়াল লক ব্যবহার করুন – ডিস্ক লক + চেইন লক একসাথে ব্যবহার করুন, বিশেষ করে রাতের বেলায় অথবা বাইক রেখে কোথাও গেলে।
  2. GPS ট্র্যাকার বসান – এখন অনেক সস্তা ট্র্যাকিং ডিভাইস পাওয়া যায়, যেগুলো মোবাইল অ্যাপে বাইকের কারেন্ট লোকেশন দেখায়।
  3. অ্যলার্ম সিস্টেম – কিছু বাইকে সেন্সর বেইসড অ্যলার্ম দেওয়া যায় যা নড়াচড়া হলেই বাজতে শুরু করে।
  4. রাতের বেলায় বাইক বাসার ভেতরে রাখুন – সম্ভব হলে নিজস্ব গ্যারেজ বা বারান্দায় রাখুন।
  5. অপরিচিত লোককে বাইক চালাতে দেবেন না – বাইক পরিষ্কার অথবা নানান কথা বলে অনেক সময় বাইক নিয়ে চলে যায়।
  6. সিসি ক্যামেরার আওতায় রাখুন – আপনি যদি অফিসে বা মার্কেটে বাইক রাখেন, তাহলে এমন স্থানে রাখুন যেখানে ক্যামেরা কভার করে।

১৫. মেয়েদের জন্য আলাদা বাইক চয়েস?

আজকাল মেয়েরাও স্বাধীনভাবে বাইক চালাতে আগ্রহী হচ্ছেন, এবং এটা সত্যিই একটা বড় সামাজিক অগ্রগতি। তবে তাদের বাইক চয়েস কিছুটা আলাদা হওয়া উচিত—হালকা ওজন, আরামদায়ক সিট, সহজ কন্ট্রোল এবং ভালো মাইলেজ—এই দিকগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নিচে কয়েকটি জনপ্রিয় মডেল ও আমার পর্যবেক্ষণ সাজিয়েছি:

Hero Pleasure Plus

  • ওজন মাত্র ১০৪ কেজি, তাই সহজে কন্ট্রোল করা যায়।
  • সেল্ফ স্টার্ট, মোবাইল চার্জার, ইঞ্জিন কিল সুইচ ইত্যাদি ফিচার।
  • মাইলেজ ৫০+ কিমি/লিটার।
  • যারা নতুন চালাতে শিখছেন, তাদের জন্য দারুন পছন্দ।

Honda Dio

  • স্পোর্টি ডিজাইন ও স্টাইলিশ লুক, অনেক মেয়েই পছন্দ করেন।
  • খুবই স্মুথ রাইডিং ফিল দেয়।
  • ফাই ইঞ্জিন ও ইকোনোমি মোড থাকায় ফুয়েল ইফিশিয়েন্ট।

TVS Scooty Zest 110

  • ওজন কম হওয়ায় মেয়েদের জন্য খুব সুবিধাজনক।
  • বড় সিট স্পেস ও বিশাল বুট স্পেস—ব্যাগ বা হেলমেট রাখা যায়।
  • মাইলেজ ৬০ কিমি/লিটার পর্যন্ত পাওয়া যায়।

Suzuki Access 125 (for a little power)

  • যারা একটু বেশি পাওয়ার চান, তারা ১২৫ সিসি এই স্কুটারটি বেছে নিতে পারেন।
  • ভারসাম্য, স্ট্যাবিলিটি এবং স্টাইলের চমৎকার সংমিশ্রণ।

⚠️ কেন মেয়েদের আলাদা বাইক দরকার?

  1. উচ্চতা ও শারীরিক কাঠামোর সাথে মানানসই হতে হবে।
  2. ট্র্যাফিকে বারবার থামতে/চালাতে যেন কষ্ট না হয়।
  3. কমপ্লেক্স ফিচার বাদ দিয়ে সহজ অপারেশন থাকা ভালো।

আমি নিজে পরিচিত অনেক নারী রাইডারকে Hero Pleasure বা Dio চালাতে দেখেছি। তারা বলেছে, “আরাম আর কন্ট্রোল—এই দুইটা জিনিসের জন্য এই বাইকগুলো সেরা।”


📝 অতিরিক্ত কিছু ব্যক্তিগত পরামর্শ:

  • বাইক কেনার আগে ১–২ জন বন্ধু বা অভিজ্ঞ বাইকার সঙ্গে নিন।
  • ইউটিউব ভিডিও দেখে এক্সপার্ট মতামত শুনুন, কিন্তু অন্ধভাবে অনুসরণ করবেন না।
  • নিজের বাইক নিজেই মেনটেইন করতে শিখুন — এটা টাকার সাশ্রয় করবে।

বাইক কেনা একটা আনন্দের ব্যাপার, তবে সেই আনন্দ যেন পরে দুর্ভোগে না রূপ নেয় সেজন্য প্রস্তুত থাকা জরুরি। আমি আমার প্রথম বাইক কেনার সময় কিছু ভুল করেছিলাম, কিন্তু এখন অনেক কিছু শিখেছি। তাই এই লেখাটা শেয়ার করলাম, যেন আপনারা উপকৃত হন।

বাইকে শুধু টাকা নয়, নিরাপত্তা, সময়, এবং আত্মবিশ্বাস বিনিয়োগ হয়। তাই কেনার আগে নিজের চাহিদা বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত নিন।

ধন্যবাদ!

Mehedi Hasan Moon

Mehedi Hasan Moon is a 19-year-old tech enthusiast from Rangpur, Bangladesh. With a passion for electronics and consumer products, he provides insightful reviews, up-to-date information, and in-depth research on the latest gadgets and technologies. Mehedi is dedicated to helping consumers make informed decisions by breaking down complex tech trends into… More »

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button